khagrachari Plus
খাগড়াছড়িশনিবার , ৬ ডিসেম্বর ২০২৫
Khagrachari plus ads
আজকের সর্বশেষ সবখবর

৬ ডিসেম্বর: মুক্তিযুদ্ধে লক্ষীছড়ি শত্রুমুক্ত হওয়ার গৌরবময় দিন

রমজান আলী জিসান
০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ৮:৩৫ অপরাহ্ণ ১৩৮ জন পড়েছেন
Link Copied!

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর- ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী নয় মাসের সংগ্রামের শেষে বাঙালি পেয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ, পেয়েছিল লাল-সবুজের পতাকা আর একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। ৩০ লাখ শহীদ ও অসংখ্য মা-বোনের ত্যাগে অর্জিত সেই মহান মুক্তির স্মৃতি আজও সমান গৌরবময়। সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আজ ৬ ডিসেম্বর, খাগড়াছড়ির লক্ষীছড়ি উপজেলা শত্রুমুক্ত হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে।

তখনকার লক্ষীছড়ি ছিল এক দুর্গম জনপদ। যোগাযোগব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের আভাস এখানে পৌঁছায় অনেক দেরিতে। যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস পর এ অঞ্চলের মানুষ ধীরে ধীরে যুদ্ধে সম্পৃক্ত হতে শুরু করে। বাঙালি যোদ্ধা মো. ফজলে বারী পাহাড়ি সম্প্রদায়ের মানুষদের যুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেন। স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণের সুযোগ না থাকায় অনেকে ভারত গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। যুদ্ধজুড়ে পাহাড়ি-বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ মুক্তিবাহিনীকে আশ্রয়, তথ্য এবং গাইডসহ নানাভাবে সহযোগিতা করেন।

লক্ষীছড়ি তখন মুক্তিবাহিনীর চলাচল ও সমন্বয়ের একটি প্রধান রুটে পরিণত হয়। সহযোগীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- বাইন্যাছোলা পাড়ার সূর্যসেনের বাপ, কৃষ্ণ কুমার চাকমা, তেস্বী মহাজন (তেজেন্দ্র লাল চাকমা), ফুল কুমার চাকমা, সাধন কুমার চাকমা; ডিপি পাড়ার সুলতানা মাঝি, আলী মিয়া মাতব্বর, আবুল কাসেম ও সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী; সাওতাল পাড়ার মানিক সিং সাওতাল; উপজেলা সদরের মনোরাম কার্বারী; দেওয়ানপাড়ার গুজেন্দ্র চাকমা ও পিয়ারী হেডম্যান; চাইল্যাতলীর লাইয়া মহাজন; বার্মাছড়ির রবি ভূষণ চাকমা ও কুসুম মালার বাপসহ বহু মানুষ।

মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে আনা-নেয়ার কাজে তথা নিরাপদ যোগাযোগ নিশ্চিত করা এবং আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা- এই কাজে সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত ছিলেন তেস্বী মহাজন, লাইয়া মহাজন ও গুজেন্দ্র চাকমা।

জুলাইয়ের শুরুতে প্রথমবার পাকবাহিনী লক্ষ্মীছড়িতে আক্রমণ চালায়। মানিকছড়ি থেকে নিয়মিত অভিযান চালিয়ে তারা স্থানীয়দের আতঙ্কে রাখে। মুক্তিবাহিনীকে সহায়তার অভিযোগে পাকসেনারা সুরপতি চৌধুরীকে হত্যা করে এবং দেওয়ানপাড়ার ‘চিকমা’ নামে এক নারীকে ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালায়। মেজরপাড়া যুদ্ধের পর পাকসেনারা দোজরী পাড়ার পাহাড়ি ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়।

রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়ি ও কাঞ্চনপুর থেকে আসা প্রায় ৩০–৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল মেজরপাড়ায় পাকবাহিনীর মুখোমুখি হয়। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকসেনাদের টানা গুলিবর্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। এ যুদ্ধে রাঙ্গুনিয়ার কবির আহমেদ গুলিবিদ্ধ হন এবং স্থানীয়দের সহযোগিতায় পরে তাঁকে উদ্ধার করা হয়। পরবর্তী সময়ে মুক্তিবাহিনী খীরাম এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে সীমান্ত এলাকা দিয়ে নতুন যোদ্ধাদের গোপনে দেশে আনার দায়িত্ব পালন করে।

আগস্টের শেষদিকে পাকবাহিনী হাতিতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ তুলে লক্ষ্মীছড়ির উদ্দেশে অগ্রসর হয়। মেজরপাড়ার দুই পাহাড়ের মাঝখানে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে আক্রমণ করলে প্রায় দুই ঘণ্টার সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধে দুই পাকসেনা নিহত হয়, বাকিরা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে মানিকছড়ির দিকে পালিয়ে যায়। একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

লক্ষ্মীছড়ির মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে ছিলেন মো. সরোয়ার কামাল, অনিল মহাজন, জয়নাল আবেদীন মিন্টু ও সুবাস দাশ। সুবাস দাশ ত্রিপুরা রাজ্যে প্রশিক্ষণ নিয়ে একাধিক যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

অবশেষে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর, পাকবাহিনীর দখল থেকে লক্ষ্মীছড়ি সম্পূর্ণ মুক্ত হয়। এদিন স্থানীয় ব্যবসায়ী নজির সওদাগর ও বাবুল সওদাগর বর্তমান থানার ছোট ইপিআর ফাঁড়িতে প্রথম লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন- যা আজও এ অঞ্চলের মানুষের কাছে এক গর্বের স্মৃতি।

তথ্যসূত্র অনুযায়ী, এ অঞ্চলে যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল কান্তি মহাজন (সাঁওতাল পাড়া), বীর মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ দাশ (বাইন্যাছোলা) এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ধর্মচরণ চাকমা (গলাছড়ি)।

বর্তমানে সরকারি গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন ৯ জন। ক্রমানুসারে: ১. খন্দকার অঃ ওহাব (লক্ষীছড়ি বাজার) ২. আব্দুল গনি (মগাইছড়ি) ৩. ফজলুল হক (মগাইছড়ি নতুন পাড়া) ৪. আবুল হাসেম মোল্লা (লক্ষীছড়ি গুচ্ছগ্রাম) ৫. নূর মোহাম্মদ (মহিষকাটা) ৬. নূরুল ইসলাম মাস্টার (জুর্গাছড়ি) ৭. ফজুলর রহমান (জুর্গাছড়ি) ৮. ধর্মচরণ চাকমা (গলাছড়ি) ৯. আবদুল খালেক (ময়ূরখীল)

এই প্রতিবেদনের সকল তথ্য সংগৃহীত হয়েছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ (৯ম খণ্ড), মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত তালিকা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পার্বত্য নিউজ থেকে।

লক্ষীছড়ি নিয়ে আরও…