khagrachari Plus
খাগড়াছড়িবুধবার , ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫
Khagrachari plus ads
আজকের সর্বশেষ সবখবর

পাহাড়ের বুক চিরে প্রাণের স্পন্দন: বৈচিত্র্যময় জনজীবন ও আগামীর পর্যটন

নিজস্ব প্রতিনিধি
২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:২১ পূর্বাহ্ণ ১৭৭ জন পড়েছেন
Link Copied!

লেখক : মোঃ সহিদুল ইসলাম সুমন, অর্থনীতি বিশ্লেষককলামিস্ট  সদস্যখাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ।

পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে যে জীবন লুকিয়ে আছে, তা কেবল দূর থেকে দেখা কোনো রঙিন ক্যানভাস বা ছবির মতো নয়। সেখানে মেঘের সাথে মানুষের মিতালি চলে রোজ, আর বাতাসের শব্দে মিশে থাকে হাজার বছরের পুরনো কোনো বাঁশির সুর। বাংলাদেশের মানচিত্রের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে যে পাহাড়ি জনপদ, যা আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম বলে চিনি, তা আসলে এক রহস্যময় আর গভীর অনুভবের জায়গা। রাঙামাটি, বান্দরবান আর খাগড়াছড়ি—এই তিনটি জেলা নিয়ে আমাদের যে ভূখণ্ড, সেখানে কেবল উঁচু-নিচু পাহাড় আর ঘন সবুজ বন নেই, বরং সেখানে জড়িয়ে আছে এগারোটিরও বেশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিচিত্র জীবনধারা। এই মানুষগুলোর জীবন খুব সহজ, আবার পাহাড়ের মতোই কঠিন। তাদের ঘরবাড়ি তৈরির ঢং থেকে শুরু করে খাবার দাবারের স্বাদ, সবকিছুতেই এক অদ্ভুত মাটির গন্ধ লেগে থাকে। অথচ আমরা সমতলের মানুষগুলো যখন পর্যটক সেজে সেখানে যাই, অনেক সময় এই গভীরতাটুকু টেরই পাই না। আমাদের কাছে পাহাড় মানে কেবল সাজেক ভ্যালিতে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলা কিংবা কাপ্তাই হ্রদে একটু নৌকা ভ্রমণ। কিন্তু পাহাড়ের সত্যিকারের আত্মা লুকিয়ে আছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মরো কিংবা তঞ্চঙ্গ্যাদের মাচাং ঘরে, তাদের বোনা পিনন-হাদিতে আর  পাহাড়ের ওই ঘাম ঝরানো শ্রমে।

এই যে নৃগোষ্ঠীগুলোর কথা বলছি, তাদের প্রত্যেকের আলাদা ভাষা, আলাদা পোশাক আর একেবারেই নিজস্ব উৎসব রয়েছে। চাকমাদের ‘বিজু’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ আর ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’—সব মিলিয়ে যে ‘বৈসাবি’ উৎসব হয়, তা কেবল একঘেয়ে আনন্দ নয়, বরং প্রকৃতির প্রতি এক পরম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। পাহাড়ের এই মানুষগুলো বিশ্বাস করে, প্রকৃতি খুশি থাকলে তবেই তাদের জীবন সার্থক হবে। আপনি যখন কোনো মারমা পল্লিতে যাবেন, দেখবেন তাদের অদ্ভুত সুন্দর কাঠের কারুকার্য করা ঘরগুলো। তারা বাঁশ আর বেত দিয়ে এমন সব জিনিস তৈরি করে যা বর্তমানের আধুনিক প্লাস্টিক সংস্কৃতির গালে একটা বড় চড় হতে পারে। তাদের খাদ্যাভ্যাসও বেশ চমৎকার। পাহাড়ের ঢাল থেকে পেড়ে আনা বাঁশ কোড়ল বা নাপ্পি দিয়ে তৈরি তরকারি যখন তারা মাটির হাঁড়িতে রান্না করে, সেই সুবাসে পুরো পাহাড় যেন ম-ম করে। এই যে অকৃত্রিমতা, এটাই আমাদের দেশের আসল সম্পদ। আমাদের দেশের এই বৈচিত্র্যকে আমরা যদি সঠিকভাবে পৃথিবীর কাছে তুলে ধরতে পারতাম, তবে পাহাড় কেবল ভ্রমণের জায়গা থাকত না, বরং হয়ে উঠত সংস্কৃতির এক বড় পাঠশালা।

আজকাল আমরা একটা শব্দ খুব বেশি শুনছি—’ইকোট্যুরিজম’ বা পরিবেশবান্ধব পর্যটন। সত্যি বলতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম এই ইকোট্যুরিজমের জন্য এক অনন্য খনি। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা পর্যটন বলতে বুঝি বিশাল বিশাল দালান, এসি রুম আর পাহাড় কেটে রাস্তা বানানো। এটা আসলে পর্যটন নয়, বরং প্রকৃতির গলা টিপে ধরা। ইকোট্যুরিজম মানে হলো আপনি প্রকৃতিতে যাবেন কিন্তু প্রকৃতিকে বিরক্ত করবেন না। আপনি পাহাড়ি মানুষের অতিথি হয়ে তাদের মাচাং ঘরে থাকবেন, তাদের স্থানীয় খাবার খাবেন এবং তাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠবেন। এতে একদিকে যেমন পাহাড়ের পরিবেশ রক্ষা পায়, অন্যদিকে স্থানীয় মানুষগুলোও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়। পর্যটন যদি কেবল বড় বড় ব্যবসায়ীদের পকেট ভারী করার মাধ্যম হয়, তবে পাহাড়ের ওই সাধারণ মানুষের কী লাভ হলো? আমাদের উচিত এমন এক ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেখানে পর্যটক আসবে নির্জনতা খুঁজতে, পাহাড়ের আদিম ঘ্রাণ নিতে। খাগড়াছড়ির আলুটিলা গুহা কিংবা বান্দরবানের নীলগিরি—এসব জায়গার প্রকৃত সৌন্দর্য রক্ষা করতে হলে আমাদের প্লাস্টিক আর কোলাহলমুক্ত পর্যটন নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন সম্ভাবনা নিয়ে যখন কথা হয়, তখন একটা বিষয় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, তা হলো যোগাযোগ আর নিরাপত্তা। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলো ইদানীং বেশ ভালো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দুর্গম এলাকার অনেক সৌন্দর্য এখনো আমাদের চোখের আড়ালে রয়ে গেছে। নাফাখুম বা অমিয়াখুমের মতো জলপ্রপাতগুলোতে পৌঁছাতে যে কষ্ট করতে হয়, সেই কষ্টই আসলে ভ্রমণের আসল আনন্দ। এই যে ঝরনার শীতল জল বা পাথুরে নদীর বয়ে চলা—এগুলো রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। আজকাল দেখা যায় পর্যটকরা চিপসের প্যাকেট বা পানির বোতল যেখানে সেখানে ফেলে পাহাড়ের পরিবেশ নষ্ট করছে। এটা খুবই দুঃখজনক। পাহাড় আমাদের দেয় অনেক কিছু, বিনিময়ে আমরা তাকে দিচ্ছি কেবল আবর্জনা। পর্যটনকে শিল্পের মর্যাদা দিতে হলে আগে আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে। পাহাড়ি মানুষগুলো যেভাবে পাহাড়কে আগলে রাখে, আমাদেরও সেই শিক্ষা নিতে হবে। আমরা যদি তাদের জীবনযাত্রার সাথে মিশে যেতে পারি, তবেই পাহাড়ের আসল রূপ দেখা সম্ভব হবে।

পাহাড়ের নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মরো বা মুরংদের জীবনযাত্রা সবচেয়ে বেশি রোমাঞ্চকর বলে আমার মনে হয়। তাদের তৈরি বাঁশির সুর শুনলে মনে হয় কোনো অপার্থিব জগত থেকে ডাক আসছে। তাদের নিজস্ব বিশ্বাস আর জীবনদর্শন এতই স্বচ্ছ যে, আধুনিক সভ্যতার অনেক জটিলতা সেখানে নেই। আবার তঞ্চঙ্গ্যাদের অলংকারের বৈচিত্র্য বা চাকমাদের তাঁতের কাপড়ের বুনন—এসবই আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ। এই যে এতসব অমূল্য সম্পদ আমাদের হাতের নাগালে, আমরা কি পারি না এগুলোকে কেন্দ্র করে টেকসই পর্যটন গড়ে তুলতে? ইকোট্যুরিজমের অন্যতম শর্ত হলো স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। যখন একজন পর্যটক পাহাড়ের মানুষের কাছ থেকে তাদের গল্প শুনবেন, তাদের হস্তশিল্প কিনবেন, তখন একটা সত্যিকারের সেতুবন্ধন তৈরি হবে। পর্যটন মানে শুধু ঘুরে বেড়ানো নয়, বরং মানুষের সাথে মানুষের পরিচয় হওয়া। পার্বত্য চট্টগ্রামে এই সুযোগটা অন্য যেকোনো জায়গার চেয়ে বেশি।

একটা ব্যাপার আমাদের মানতেই হবে, পাহাড়ের ভারসাম্য খুব নাজুক। এখানে যত্রতত্র পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুললে পাহাড় ধস বা পানির অভাবের মতো সমস্যা দেখা দেয়। তাই আমাদের এমন এক পরিকল্পনা দরকার যা পরিবেশের ক্ষতি না করে পর্যটকদের টেনে আনবে। ধরুন, সাজেকের মতো জায়গায় যদি শত শত রিসোর্ট না বানিয়ে সীমিত সংখ্যক এবং পরিবেশবান্ধব থাকার জায়গা করা হতো, তবে সাজেকের ওই আদিম মোহনীয়তা টিকে থাকত। এখন সাজেক অনেকটা ঘিঞ্জি শহরের মতো হয়ে যাচ্ছে। আমাদের উচিত পাহাড়ের ওপর চাপ কমানো। বান্দরবানের দূরবর্তী গ্রামগুলোতে পর্যটকদের থাকার জন্য উৎসাহিত করা যেতে পারে, তবে তা অবশ্যই প্রকৃতির নিয়ম মেনে। ইকোট্যুরিজম আসলে এক ধরনের সচেতনতা। আপনি সেখানে যাবেন পাহাড়ের বুক চিরে কোনো রাজপ্রাসাদ দেখতে নয়, বরং পাহাড়ের কোলে এক টুকরো শান্ত জীবন কাটাতে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃগোষ্ঠীগুলোর সংস্কৃতির সাথে পর্যটনকে মিলিয়ে দিলে এক চমৎকার সম্ভাবনা তৈরি হয়। এটাকে বলা যেতে পারে ‘কালচারাল ট্যুরিজম’। মানুষ যখন জানবে যে পাহাড়ের গভীরে এমন এক জাতি বাস করে যারা এখনো আদিম কায়দায় চাষ করে টিকে আছে, তখন বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের ঢল নামবে। কিন্তু সেই ঢল যেন আবার সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে না যায়। আমাদের এই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষগুলো খুব লাজুক আর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন। তাদের ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ না করে কীভাবে তাদের জীবনযাত্রা পর্যটকদের সামনে তুলে ধরা যায়, সেটা নিয়ে দক্ষ পরিকল্পনাকারীদের কাজ করতে হবে। পাহাড়ি সংস্কৃতির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা যেতে পারে, তবে তা যেন কৃত্রিম না হয়। পর্যটকরা যেন অনুভব করতে পারে তারা এই মাটিরই কোনো এক প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষী হচ্ছে।

পাহাড়ের খাবারের কথা তো আগেই বলেছি, এ নিয়ে আলাদা করে বলার অনেক কিছু আছে। পাহাড়ি খাবারগুলো মূলত তেলবিহীন এবং ভেষজ গুণসম্পন্ন। এই খাবারগুলো যদি পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে স্বাস্থ্যকর উপায়ে পরিবেশন করা যায়, তবে তা এক নতুন মাত্রা যোগ করবে। আজকাল অনেকেই অর্গানিক খাবারের সন্ধানে ঘোরেন। পাহাড়ের এই বিষমুক্ত ফল আর সবজি হতে পারে পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ। পাশাপাশি পাহাড়ি হস্তশিল্পের প্রসারে ছোট ছোট হাট বা বাজার তৈরি করা যেতে পারে, যেখান থেকে পর্যটকরা সরাসরি কারিগরদের কাছ থেকে পণ্য কিনতে পারবেন। এতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপট কমবে এবং পাহাড়ের সাধারণ মানুষের ঘরে অন্ন জুটবে। পর্যটন যখন সাধারণ মানুষের পেটে ভাত জোগাবে, তখনই তারা পর্যটকদের পরম বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে নেবে।

সবশেষে বলা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আমাদের দেশের এক অমূল্য রত্ন। এর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যদি আমরা সঠিক উপায়ে কাজে লাগাতে পারি, তবে বাংলাদেশের পর্যটন খাত এক অভাবনীয় উচ্চতায় পৌঁছে যাবে। তবে মনে রাখতে হবে, পর্যটনের নামে পাহাড়কে কংক্রিটের জঙ্গল বানানো যাবে না। প্রকৃতির সাথে মিতালি করেই আমাদের এগোতে হবে। পাহাড়ের ওই সহজ-সরল মানুষগুলোর হাসিমুখ আর মেঘের আনাগোনা যেন কোনোদিন হারিয়ে না যায়। ইকোট্যুরিজমই হোক আমাদের আগামীর পথ চলার মূলমন্ত্র। আমরা যখন পাহাড়কে সম্মান দিতে শিখব, পাহাড়ও আমাদের দুহাত ভরে সৌন্দর্য আর প্রশান্তি ফিরিয়ে দেবে। এই মাটির টান আর পাহাড়ের গান চিরকাল টিকে থাকুক আমাদের হৃদয়ে।