khagrachari Plus
খাগড়াছড়িবৃহস্পতিবার , ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
Khagrachari plus ads
আজকের সর্বশেষ সবখবর

প্রান্তিকতার দেয়াল ভেঙে ডাকসুতে পাহাড়ের তরুণদের বিজয়, জাতীয় নেতৃত্বের হাতছানি

এ এইচ এম ফারুক
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৮:৪৫ পূর্বাহ্ণ ১৯৪ জন পড়েছেন
Link Copied!

বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির অঙ্গনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) বরাবরই এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। এটি কেবল একটি ছাত্র সংগঠন নয়, বরং ভবিষ্যতের জাতীয় নেতাদের আঁতুড়ঘর। ডাকসু নির্বাচন মানেই নতুন নেতৃত্বের সন্ধান, নতুন স্বপ্নের জন্ম এবং এক নতুন ইতিহাসের সূচনা। তেমনই এক ইতিহাস রচিত হয়েছে ডাকসু ২০২৫ সালের নির্বাচনে, যখন পাহাড়ের শিক্ষার্থীরা তাদের মেধা, সাহস ও দৃঢ়তা দিয়ে জয় করে নিয়েছেন নেতৃত্বের সর্বোচ্চ আসনগুলো। এই বিজয় শুধু কোনো ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের এক নতুন আত্মপ্রকাশ, একটি অবহেলিত ভূখণ্ডের বহু প্রতীক্ষিত উত্থান।

ডাকসু’র দীর্ঘ ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল- যেকোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে সর্বোচ্চ দুটি পদে নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু এবারের নির্বাচনে সেই বিরল ঘটনাটিকেই বাস্তবে পরিণত করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের দুই কৃতি সন্তান। ভিপি (সহ-সভাপতি) পদে নির্বাচিত হয়েছেন খাগড়াছড়ি সদরের সাদিক কায়েম। তার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে জয়ী হয়েছেন রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলার এস. এম. ফরহাদ। এই দুই শীর্ষ পদের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে সবার নজর কেড়েছেন- খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ির মেয়ে হেমা চাকমা এবং রাঙামাটির সর্বমিত্র চাকমা। যা তাদের পরিশ্রম ও সাংগঠনিক দক্ষতার প্রতিফলন। এছাড়াও, কবি জসীমউদ্দিন হলের রিডিং রুম সম্পাদক পদে জয়লাভ করেছেন খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গার কামরুল হাসান। এই প্রতিনিধিরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি ও নৃতাত্ত্বিক উভয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করবেন। যা প্রমাণ করে যে, পাহাড়ের রাজনীতি এখন আর বিভাজনের নয়, বরং সমন্বয়ের। তারা কেবল নিজেদের অঞ্চল বা জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছেন না, বরং বাংলাদেশের বহুঁজাতি ধর্মের সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন।

পাহাড়ি নেতৃত্বের উপস্থিতি শুধু প্রতীকী নয়- এটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বীকৃতির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। দীর্ঘদিন ধরে মূলধারার রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য মানুষের জন্য এটি এক নতুন আশা ও প্রেরণার উৎস। সাদিক-ফরহাদ, হেমা-সর্বমিত্রদের এই জয় প্রমাণ করে, মেধা ও যোগ্যতা কোনো ভৌগোলিক সীমানার অধীন নয়, বরং তা দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে উঠে আসতে পারে।

ডাকসু ২০২৫-এর নির্বাচন শুধু বিজয়ীদের তালিকা দিয়ে সম্পূর্ণ হয় না, বরং সেইসব সাহসী যোদ্ধাদের কথাও স্মরণ করা প্রয়োজন, যারা জয়ী হতে না পারলেও তাদের উপস্থিতি ভবিষ্যতের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। ভিপি পদে লড়েছিলেন বান্দরবানের লামা উপজেলার হাবিবুল্লাহ আফফান নামের পার্বত্য চট্টগ্রামের আরেক সাহসী সন্তান। তার অংশগ্রহণ ছিল পাহাড়ের তরুণ প্রজন্মের উচ্চাকাঙ্ক্ষার এক অনন্য উদাহরণ। কমনরুম, রিডিং ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে খাগড়াছড়ির মেয়ে সুরমি চাকমা, যোগাযোগ মাধ্যম সম্পাদক পদে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির আব্দুল কাইয়ুম, আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে রাঙামাটির বাঘাইছড়ির তাসনিম বিন মাহফুজ এবং ক্রীড়া সম্পাদক পদে চিম চিমিয়া চাকমা-এর মতো শিক্ষার্থীরাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এছাড়াও, বান্দরবান লামার রাকিবুল ইসলাম কেন্দ্রীয় সদস্য পদে এবং আব্দুল্লাহ আল সোহানুর হল পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দেখিয়েছেন, পাহাড়ের শিক্ষার্থীরা এখন আর দর্শক নয়—তারা নেতৃত্বের দাবিদার। তাদের এই সাহসিকতা ভবিষ্যতে আরও অনেক পাহাড়ের তরুণকে অনুপ্রাণিত করবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদ, সংঘাত এবং অবহেলার এক দীর্ঘ ইতিহাস বহন করে চলেছে। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (কথিত শান্তিচুক্তি) হওয়া সত্ত্বেও, অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও নেতৃত্বের অভাব। স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিকাশ ঘটলেও, জাতীয় পর্যায়ের মূলধারার রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ ছিল সীমিত। ডাকসু ২০২৫-এর ফলাফল সেই শূন্যতাকে পূরণ করার এক নতুন সম্ভাবনা জাগিয়েছে। এই নির্বাচনে পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের জয় তাদের মূলধারার রাজনীতিতে ফিরে আসার এক সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। এটি প্রমাণ করে যে, বিচ্ছিন্নতার রাজনীতি নয়, বরং সমন্বয়ের নেতৃত্বই হতে পারে পাহাড়ের ভবিষ্যৎ।

সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতির কারণে পাহাড়ের তরুণদের একটি বড় অংশ আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর (যেমন পিসিজেএসএস ও ইউপিডিএফ) জালে জড়িয়ে নিজেদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে নষ্ট করছে। পাহাড়ের এই তরুণদের জন্য ডাকসুর এই বিজয় একটি স্পষ্ট বার্তা-সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে তারা যদি জাতীয় পর্যায়ে (শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাজনীতি) যুক্ত হয়, তবে মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব। ডাকসুতে পাহাড়ের সন্তানদের এই জয় তাদের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এটি প্রমাণ করে, মেধার জোরে তারা যেকোনো অবস্থানে নিজেদের প্রমাণ করতে সক্ষম।

ডাকসু তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় জাতীয় নেতৃত্বের প্রস্তুতি মঞ্চ। এই মঞ্চ থেকেই উঠে এসেছেন বাংলাদেশের বহু কালজয়ী নেতা। এবারের নির্বাচনে পাহাড়ি নেতৃত্বের উত্থান মানে, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ভবিষ্যতের জাতীয় নেতা উঠে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই নেতারা কেবল পাহাড়ের প্রতিনিধি নন, তারা বাংলাদেশের বহু জাতি-ধর্মের রাজনীতির প্রতীক। তাদের এই উত্থান প্রমাণ করে যে, পাহাড়ের তরুণ প্রজন্ম দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। তারা শুধু পাহাড়ের সমস্যা নিয়ে কথা বলবেন না, বরং বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নেও তাদের অবদান রাখার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

এই নেতৃত্ব যদি সঠিকভাবে বিকশিত হয়, তাহলে তা হতে পারে পাহাড়ের উন্নয়নে এক নতুন অনুঘটক। তারা তাদের অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য একটি Catalytic Force বা অনুঘটক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে, যা দীর্ঘদিনের অবহেলা থেকে পাহাড়কে মুক্ত করতে সাহায্য করবে। একইসঙ্গে, তারা পাহাড়ের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতির সেতুবন্ধন রচনা করতে পারে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তার এক বিকল্প পথ তৈরি করতে পারে। এই তরুণ নেতারা জাতীয় রাজনীতিতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সক্ষম হবেন। তাদের এই বিজয় ভবিষ্যতে পাহাড় ও সমতলের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার এক নতুন অধ্যায় সূচনা করবে। পাহাড়ের ছায়া এবার শুধু ঢাকার দেয়ালে নয়, জাতীয় সংসদের করিডোরেও পড়তে পারে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই সাফল্য প্রমাণ করে যে পাহাড় আর কোনো পিছিয়ে পড়া, অবহেলিত বা অনগ্রসর অঞ্চল নয়। বরং এখানকার শিক্ষার্থীরা মেধা, যোগ্যতা এবং সাহসিকতায় সমতলের শিক্ষার্থীদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তাই, দেশের মূলধারার রাজনীতি, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পাহাড়কে আর অবহেলার চোখে না দেখে বরং তাদের নেতৃত্বকে স্বাগত জানানো উচিত।

✒️লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Khagrachari plus ads