এইচএসসি পরীক্ষার কিছু বিষয় মাঝপথে বাতিল করা হয়েছিল পরীক্ষার্থীদের একাংশের চাপের কারণে। যেসব বিষয়ের পরীক্ষা ইতিমধ্যে শেষ হয়েছিল, সেগুলোর উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়েছে। অন্যদিকে, যেসব বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি, সেগুলোর ফলাফল এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার ভিত্তিতে বিষয় ম্যাপিং করে তৈরি করা হয়েছে।
এই প্রক্রিয়ায় প্রকাশিত এইচএসসি ফলাফল ২০২৪ নিয়ে অনেকেই আশা করেছিলেন যে, পাসের হার বেড়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে গড় পাসের হার গতবারের তুলনায় কমেছে। তবে, জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ফলাফলেও একই ধারা লক্ষ্য করা গেছে—পাসের হার কমলেও জিপিএ-৫ বেড়েছে।
আজ মঙ্গলবার একটি ভিন্ন পদ্ধতিতে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। সাধারণত, প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ফল প্রকাশের কাজ উদ্বোধন করা হতো এবং এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ফলাফলের বিস্তারিত তথ্য জানানো হতো। তবে এবার ফলাফল একযোগে বেলা ১১টায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ও অনলাইনে প্রকাশ করা হয়েছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার ফলাফলের তথ্য তুলে ধরেন। তপন কুমার সরকার আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটিরও সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এবার ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ১১ লাখ ৩১ হাজার ১১৮ জন পরীক্ষার্থী। তাদের মধ্যে পাস করেছেন ৮ লাখ ৫৪ হাজার ৬৪৪ জন, গড় পাসের হার ৭৫.৫৬ শতাংশ। গতবার এই হার ছিল ৭৬.৯ শতাংশ। এ বছর ৯টি শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৭৬ জন, যা গতবার ছিল ৭৮ হাজার ৫২১ জন।
পাসের হার কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার উল্লেখ করেন যে, যেসব বিষয়ের পরীক্ষা বাতিল হয়েছিল, সেগুলো পাসের হারে তেমন প্রভাব ফেলেনি। উচ্চমাধ্যমিক পাসের হার মূলত ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, এবং এই দুটি বিষয়ের পরীক্ষা হওয়ার ফলে গড় পাসের হার স্বাভাবিক ছিল।
জিপিএ-৫ বেড়ে যাওয়ার পেছনে বিষয় ম্যাপিংয়ের প্রভাব ছিল বলে মনে করেন তপন কুমার সরকার। তিনি ব্যাখ্যা করেন, যেসব শিক্ষার্থী এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন, তারা হয়তো এইচএসসিতে মানবিকে চলে গিয়েছেন। ফলে এসএসসির বিজ্ঞানের নম্বর মানবিকের বিষয়ে যোগ হয়েছে, যা জিপিএ-৫ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
বিষয় ম্যাপিং নতুন কোনো পদ্ধতি নয়।
করোনাকালে পরীক্ষাগুলো সম্পূর্ণভাবে নেওয়া সম্ভব না হওয়ায় বা কম বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছিল। এ বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট নীতিমালাও রয়েছে, যা অনুযায়ী নির্ধারিত হয় যে কোন পরীক্ষার কোন বিষয়ের নম্বর কোথায় যুক্ত হবে। এবার যেসব বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি, সেগুলোর ফলাফল এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার ভিত্তিতে বিষয় ম্যাপিং করে প্রকাশ করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে, একজন শিক্ষার্থী এসএসসিতে কোনো বিষয়ের যে নম্বর পেয়েছিলেন, যদি সেই বিষয়টি এইচএসসিতেও থাকে, তবে সেই নম্বর পুরোপুরি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আর যেখানে বিষয় ভিন্ন, সেখানে নীতিমালা অনুযায়ী নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে।
যেমন, যদি কেউ এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়তেন এবং এইচএসসিতে ব্যবসায় শিক্ষা বা মানবিক বিভাগে চলে আসতেন, তবে তার এসএসসির বিজ্ঞান বিষয়গুলোর নম্বর এইচএসসির ব্যবসায় শিক্ষা বা মানবিকের নৈর্বাচনিক বিষয়ের নম্বর হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
এবার এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল ৩০ জুন, যেখানে মোট পরীক্ষার্থী ছিলেন ১৩ লাখ ৩১ হাজার ৫৮ জন। সাতটি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে, পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবং পরীক্ষাগুলো একাধিকবার স্থগিত করা হয়। সেই সময়ে ছয়টি বিষয়ের পরীক্ষা এবং ব্যবহারিক পরীক্ষা বাকি ছিল। পরিস্থিতির চরমে পৌঁছালে আন্দোলন সরকার পতনের এক দফায় রূপ নেয় এবং ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। এরপর ১১ আগস্ট থেকে পরীক্ষার নতুন সময়সূচি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সময় থানাগুলিতে হামলা হওয়ায় প্রশ্নপত্র নষ্ট হয়ে যায়, যা ১১ আগস্টের পরিবর্তে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে পরীক্ষাগুলো নেওয়ার সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে। তবে, সচিবালয়ে আন্দোলনের মুখে স্থগিত পরীক্ষাগুলো অবশেষে বাতিল করা হয়।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ফলাফল প্রকাশের পর হতাশার কথা জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, পাসের হার কমে যাওয়ার পাশাপাশি কিছু বিষয়ের পরীক্ষার বাতিল হওয়া একটি চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া, জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি অবশ্যই আশাব্যঞ্জক, তবে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ওপর এটি একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পরীক্ষার ফলাফল মূল্যায়ন প্রক্রিয়া আরো স্বচ্ছ ও সঠিক হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য একটি সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্য ফলাফল প্রকাশের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
এছাড়া, এবারের ফলাফলে শিক্ষার্থীদের অভ্যর্থনা জানানো উচিত যাতে তারা ভবিষ্যতে আরো ভালো ফলাফল করার জন্য উদ্দীপনা পায়। এভাবে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাবে এবং একটি শক্তিশালী প্রজন্মের জন্ম দেবে।